সাইকেল
সাল ২০০১
-আমি জানতাম মা, তুমি পারবে ! আমার যে কি খুশি লাগছে...
সাব্বির যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে হাতে ! এমনভাবে উল্লসিত হয়ে মা কে জড়িয়ে ধরে।
-হয়েছে থাক থাক ! এত খুশি হওয়া ভাল না। অনিষ্ট হয়।
-কি যে বল না মা, আজকাল ওসব কথা চলে ?!
সাব্বির রেডি হয়ে নেয়, ঢাকা যাবার জন্য। আজ তার এমন খুশি লাগছে, কি রেখে কি করে বুঝতে পারছে না। লাগবেই তো ! বহু দিনের বায়না, ঘ্যানর-ঘ্যানর, খাদ্যবিহীন অনশনের পর আজ তার মা তাকে তার সাধের জিনিস কেনার টাকা দিয়েছে।
সাব্বিরের মনে পড়ে দিনগুলোর কথা। টিভিতে, পত্রিকায় সে দেখতো কত দুর্দান্ত কলা-কৌশল করছে তার বয়সী এমনকি তার চেয়ে ছোট ছেলেপুলে। কেওবা ঘুরছে দেশ-বিদেশ দু চাকার সাইকেলেই।
তখন থেকেই তার ইচ্ছা অমন একটা সাইকেল তারও চাই। মায়ের আঁচল ধরে ঘ্যনর ঘ্যনর শুরু হয়। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্যে হয় না। বাবার কাজ থাকে না এখন। বয়স হয়েছে। মা চালান সংসার। কখনো কাঁথা সেলাই করে কখনো বা অন্য কোন কুটির শিল্প দিয়ে চলে সংসার। এরই মধ্যে কুটির শিল্প ঋণ নিয়েছেন মা, ২০ হাজার টাকা। সেগুলোই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। বিষয়টা জানার পর সাব্বির জিজ্ঞেস করে মাকে,
-এত ঋণ শোধ হবে কি করে মা?
-আমাদের সমস্যা কবে শেষ হয় তা খোদা ভাল জানে। তাই বলে তোর আহ্লাদ অপূর্ণ থাকবে কেন ততদিন !
এটা ঠিক যে কিনলেই কেনা হয়ে যাবে। কিন্তু ঋণের কথাটা বার বার মাথায় ঘুরতে থাকে পরিশোধের আগ পর্যন্ত। সেই দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে ছেলের মুখের হাঁসিটা গেঁথে গেছে মনে। মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় স্বস্তি আর নেই।
বেরোল সাব্বির বাসা থেকে, আবার দু ঘণ্টায় ফিরে আসলো বাসায়।
-কিরে ফিরে আসলি যে?
-ওহ মা, ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল পরীক্ষা আছে। সবগুলো শেষ হতে এ সপ্তাহ লাগবে।
-তাহলে?
- সামনের সপ্তাহে যাব।
গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই মাকে জিজ্ঞেস করে,
-রাকিবকে জানিয়েছ? জানিয়েছ আমি সাইকেল কিনবো?
-নাহ, এমনিতেই টাকা চেয়েছে দিতে পারি নি। তার উপর এটার কথা শুনলে বলবে,” দেখো দেখো, ছোট ছেলের কদর দেখ !”
বাবু মুচকি হাসে। বাবু জানে রাকিব টাকা চেয়েছিল পরশু। চাকরীর পরীক্ষা দেয়ার জন্য।
ও হ্যাঁ, রাকিব সাব্বিরের বড় ভাই। ঢাকাতেই থাকে। এস.এস.সি এর মতো ইন্টারমিডিয়েটে ভাল করলে সবার সিদ্ধান্তে ঢাকা পাঠিয়ে দেন মা। সেখানে গিয়ে রাকিব অনেক সমঝদার হয়ে গেছে। বাড়িতেও খুব একটা আসে না। দু একবার এসেছিল সাব্বির তখন স্কুলে ক্লাসে। এসে পায় নি। দিনে এসে দিনেই চলে যায়।
বাবু মুচকি হাসে কারণ সে আজকে বলে বেড়ানোর মতো একটা কাজ করেও বলে নি মা কে। ৫ হাজার টাকা মানিগ্রাম করে দিয়েছে রাকিবের কাছে, ওইটুকু সময়ের ভিতরে। আর একটা চিঠিও দিয়েছে সাথে। তাতে ইংরেজিতে একটা শব্দ লেখা, “সারপ্রাইজ !”।টাকা চিঠি যেটাই আগে যাক পাওয়ার পর যে রাকিব কেমন খুশি হবে তা ভেবেই সাব্বির খুশি। অবশ্য এমনি এমনি দেয় নি সে। এটা বিনিয়োগ। ভাইয়ের চাকরী হলে সে প্রতি মাসে অনেক টাকা নিয়ে উশুল করে নিবে। “হা হা হা, আমি এখন বিনিয়োগকারী ! উদ্যোক্তা !...” ভাবে সাব্বির।
দশম শ্রেণিতে এবার সাব্বির। রাকিব যখন ঢাকা যায় তখন সে ক্লাস ৬-এ। কত ছোট ছিল সে তখন। হঠাত করেই বড় হয়ে যায় দু-তিন বছরে। রাকিব চাকরী পেয়ে এসে তো তাকে চিনতেই পারবে না !
যাই হোক সাইকেলের চিন্তায় পরীক্ষাগুলো যাচ্ছেতাই হয়েছে। “তবুও শেষ হলো তো !” ভেবে হাঁফ ছাড়ে সাব্বির।
জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটলো অবশেষে।
-মা আসি...
-সাবধানে যাস। আর ট্রেনে অপরিচিত কারোর দেয়া কিছু খাবি না।
বের হতে হতে বলে
-আচ্ছা মা।
মা পিছু পিছু যাচ্ছে রাস্তা পর্যন্ত। আজকেই চলে আসবে তবুও কত বাহানা করে দেখছে ছেলেটাকে
-আর কারোর সাথে ঝামেলায় যাস না। অপরিচিত কোন স্টেশনে নামবি না কিন্তু...
-আহ মা, তুমি শুধু শুধু ভাবছ। ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দাও, ঘুমের মাঝেই ক্রিং ক্রিং শুনবে। উঠে দেখবে আমি সাইকেল নিয়ে হাজির !
ভটভটিতে চড়ে স্টেশন পৌছায় সাব্বির। সময়মতই ছাড়ে ট্রেন, মানে নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টার মধ্যেই ছাড়ে।
ঢাকা, বরাবরই একটা যন্ত্রণার নাম। জ্যাম, মানুষের ভিড়, ব্যাস্ততা। কেও কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই যেন। পত্রিকা থেকে টুকে রাখা সাইকেলের দোকানটার হদিস খুঁজে পায় সে অনেক কষ্টে। হকার, ট্রাফিক পুলিশ এমনকি ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করে। তার সরলতার জন্যেই হয়তো কেও হতাশ করে নি তাকে।
দোকানে সাব্বির।
-আসেন ভাই। (পোশাক-পরিচ্ছদ ফুলবাবুর মত না হওয়ায় কথায় খুব স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না বিক্রেতার)
ভেতরে ঢোকে সে। কত রকমের সাইকেল এখানে। টিভিতে যদিও আরো ভাল ভাল সাইকেল দেখেছে, বাস্তবে দেখেনি সে আগে। তাও একসাথে এতগুলো !
-আপনি কোন ধরণের সাইকেল চাচ্ছেন?
-জ্বি, ওই যে টিভিতে যে দেখায়। ভাঙ্গা পাথুরে রাস্তায় চালায়, স্টান্ট করা যায়...
নামটা জানতো সাব্বির কিন্তু উত্তেজনায় মনে পড়ছিল না।
-মাউন্টেন বাইক?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, জ্বি...
দোতলায় নিয়ে যায় তাকে। সেখানে শুধু মাউন্টেন বাইক, শয়ে শয়ে সাজানো।
-দাম কত কোনটার?
-আপনি আগে পছন্দ করেন। দাম নিয়ে ভাববেন না।
কথায় একটা অবজ্ঞা ছিল। দোকানি ধরেই নিয়েছিল দাম শুনে আর আগে বাড়বে না সে।
-না না, তবুও বলেন কোনটা কত?
এক একটা সাইকেলের পাশে যেয়ে দেখাচ্ছে
-এটা ১৪ হাজার টাকা... আর এই নীলটা ২০ হাজার টাকা।
এভাবে দাম বাড়তি হিসেবে সাজানো হয়ত সাইকেল গুলো।
নীল সাইকেলটা মনে ধরেছিল। নিতে পারছে না বলে মন খারাপ হল। আবার এটা ভেবেও ভাল লাগলো, “রাকিব নিশ্চয়ই এতদিনে টাকাটা পেয়ে গেছে। খুব খুশি হয়েছে নিশ্চয়ই !” ।
অগত্যা ১৪ হাজার টাকা দামের সাইকেলটাই নিল সে। সাথে একটা ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক বেল, মাকে ঘুম থেকে জাগাতে হবে যেয়ে। ১৫০ টাকা দামেরটা নিল সে।
দোকানি অবশ্য বেশ অবাক।
-স্যার আমরা তুলে দিচ্ছি রিকশায়।
সে মাথা নাড়ে। ব্যাবহারের পরিবর্তন তার চোখে পড়ে না। সাইকেল পেয়েছে সে, আর কিছু ভাবার সময় আছে?
সাইকেলটা ট্রেনের একপাশে বেঁধে নিয়ে রওনা হয় কমলাপুর থেকে।
সাব্বিরের ট্রেনটা যখন কমলাপুর থেকে ছাড়ছে সেই সময়ে টঙ্গি স্টেশন ( কমলাপুরের দুই স্টেশন পরেই এটি ) এলাকায় এক গলিতে...
-ভাই একটু দাঁড়ান। কয়টা বাজে?
-৪ টা পাঁচ ভাই।
-ঘড়িটা তো বেশ !
-বড় ভাই পাঠিয়েছে আমার জন্য।
বলতেই আরো দুইজন ঘিরে ধরে একটি ছেলেকে। বুঝতে আর বাকি নেই এরা ছিনতাইকারী।
-ভাই আমি আপনাদের ছোট ভাইয়ের মতো ভাই। ঘড়িটা আমার খুব পছন্দের, ভাইয়ের দেয়া প্রথম উপহার।
-আমাদেরও খুব ভাল লেগেছে। তাছাড়া তোমার ভাই তো আমাদেরও ভাই...
ছেলেটা কিছু বলে না আর। নীরবে খুলে দেয় হাতের সোনালী ঘড়িটা । মুখে না বললেও খোদার দরবারে বিচার দিয়েছে ঠিকই। যদিও ঘড়িটা আর পাবে না সে।
ছিনতাইকারীরা ঘড়িটা নিয়ে টঙ্গি স্টেশন আসতে আসতেই সাব্বিরের ট্রেনও ঢুকল। তিন মিনিট থামবে। সাব্বিরের ইচ্ছা করছে এখানেই নেমে সাইকেলটা চালিয়ে দেখতে !
ওদিকে নিচে থেকেও দুজন যেন দেখছিল। সে ভাবে, তাদেরও হয়ত নামিয়ে চালাতে ইচ্ছা করছে!
ট্রেন ছেড়ে দিল, গতি বাড়ছে। ওমা, লোক গুলোতো সত্যিই সাইকেল নামিয়ে নিল। মায়ের উপদেশ ভুলে যায় সে। নেমে যায় লাফিয়ে। ট্রেন চলে গেছে, সে দৌড়ে কিছুদূর যেতেই ধরে ফেলে সাইকেল ছিনতাইকারীদের, টানাহ্যাচরা-ধস্তাধস্তি শুরু হয়। এদিকে ট্রেনের ওপাশে থাকা ছিনতাইকারীদের আরেকজন দেখতে পায় এটা। কোমরে তার নতুন পিস্তল, সদ্য কেনা। নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে সব। নিজের লোকের অস্তিত্ব বুঝলো। মাথায় রঙ্গিন নেশা, “গুলির টিপটা পরখ করে দেখা যাক?”
যেই ভাবা সেই কাজ। উঠে একটু এগিয়ে গুলিতে এক টিপ দিয়ে দিল। শব্দ নেই তেমন, বিদেশি পিস্তল। কিন্তু তিনজনের একজন শান্ত হয়ে ঢলে পড়লো।
-আরে, আমার লোক মরলো নাকি?
টলতে টলতে কাছে যায় তৃতীয় ছিনতাইকারী।
-নাহ, ও দু ব্যাটা মরে নি।
প্রথম টিপেই সফল!
-অভাগাটার মুখ দেখি?
উল্টে থাকা মুখটা সোজা করতেই শরীরে হিম বয়ে যায়। আগে মৃত মানুষ দেখেনি? দেখেছে তো। বাকি দুজন বুঝতে পারে না কিছুই।
আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দেয় খুনি।
-এই সারপ্রাইজ কেন দিলি তুই! কেন টাকা পাঠালি... প্রতিদিন কেন যাস তুই স্কুলে?
বাকি দুজন তখনো কিছু বুঝে উঠেনি। সন্ধ্যা নেমে আসে।
বাড়িতে মায়ের ঘুম ভাঙ্গে ক্রিং ক্রিং শব্দে।সাইকেলে করে ডাক-হরকরা এসেছে। বড় ছেলে চিঠি লিখেছে। সে টাকা পেয়েছে। এবার বাড়িতে এলে থাকবে একদিন এমনটা লিখেছে চিঠিতে।
এদিকে বড় ভাইয়ের কোলে ছোট ভাইয়ের লাশ।বড় ভাইয়ের চেলাগুলো সাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছিল, আর একটা ট্রেনও চলে যায় ভাইদের উপর দিয়ে।
Shaon 070
#Say_No_to_Drugs
(আমিও ছোটবেলা থেকেই সাইকেল পাগল। সাইকেল নিয়ে চিন্তায় বুঁদ থাকতাম। কি ভেবে যে এটা লিখেছিলাম!
অবশ্য আজকের পুনর্লিখনটা আরেক সাইকেল নেশায় মত্য মৎস্যবিদ বড়ভাইয়ের। সাব্বির ভাই।
গল্পটা নিয়ে একটা শর্ট-ফিল্মের ইচ্ছা ছিল! কালের পরিবর্তনে বাস্তবের নায়ককে উৎসর্গ করে কিছুটা হলেও তা পূরণ হলো !)
পুনর্লিখনঃ
ভোর ৬ টা ৫০
২৮শে মার্চ, ২০১৯
মুলগল্পঃ
রাত ১২টা ১৫
৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
-আমি জানতাম মা, তুমি পারবে ! আমার যে কি খুশি লাগছে...
সাব্বির যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে হাতে ! এমনভাবে উল্লসিত হয়ে মা কে জড়িয়ে ধরে।
-হয়েছে থাক থাক ! এত খুশি হওয়া ভাল না। অনিষ্ট হয়।
-কি যে বল না মা, আজকাল ওসব কথা চলে ?!
সাব্বির রেডি হয়ে নেয়, ঢাকা যাবার জন্য। আজ তার এমন খুশি লাগছে, কি রেখে কি করে বুঝতে পারছে না। লাগবেই তো ! বহু দিনের বায়না, ঘ্যানর-ঘ্যানর, খাদ্যবিহীন অনশনের পর আজ তার মা তাকে তার সাধের জিনিস কেনার টাকা দিয়েছে।
সাব্বিরের মনে পড়ে দিনগুলোর কথা। টিভিতে, পত্রিকায় সে দেখতো কত দুর্দান্ত কলা-কৌশল করছে তার বয়সী এমনকি তার চেয়ে ছোট ছেলেপুলে। কেওবা ঘুরছে দেশ-বিদেশ দু চাকার সাইকেলেই।
তখন থেকেই তার ইচ্ছা অমন একটা সাইকেল তারও চাই। মায়ের আঁচল ধরে ঘ্যনর ঘ্যনর শুরু হয়। কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্যে হয় না। বাবার কাজ থাকে না এখন। বয়স হয়েছে। মা চালান সংসার। কখনো কাঁথা সেলাই করে কখনো বা অন্য কোন কুটির শিল্প দিয়ে চলে সংসার। এরই মধ্যে কুটির শিল্প ঋণ নিয়েছেন মা, ২০ হাজার টাকা। সেগুলোই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। বিষয়টা জানার পর সাব্বির জিজ্ঞেস করে মাকে,
-এত ঋণ শোধ হবে কি করে মা?
-আমাদের সমস্যা কবে শেষ হয় তা খোদা ভাল জানে। তাই বলে তোর আহ্লাদ অপূর্ণ থাকবে কেন ততদিন !
এটা ঠিক যে কিনলেই কেনা হয়ে যাবে। কিন্তু ঋণের কথাটা বার বার মাথায় ঘুরতে থাকে পরিশোধের আগ পর্যন্ত। সেই দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে ছেলের মুখের হাঁসিটা গেঁথে গেছে মনে। মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় স্বস্তি আর নেই।
বেরোল সাব্বির বাসা থেকে, আবার দু ঘণ্টায় ফিরে আসলো বাসায়।
-কিরে ফিরে আসলি যে?
-ওহ মা, ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল পরীক্ষা আছে। সবগুলো শেষ হতে এ সপ্তাহ লাগবে।
-তাহলে?
- সামনের সপ্তাহে যাব।
গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই মাকে জিজ্ঞেস করে,
-রাকিবকে জানিয়েছ? জানিয়েছ আমি সাইকেল কিনবো?
-নাহ, এমনিতেই টাকা চেয়েছে দিতে পারি নি। তার উপর এটার কথা শুনলে বলবে,” দেখো দেখো, ছোট ছেলের কদর দেখ !”
বাবু মুচকি হাসে। বাবু জানে রাকিব টাকা চেয়েছিল পরশু। চাকরীর পরীক্ষা দেয়ার জন্য।
ও হ্যাঁ, রাকিব সাব্বিরের বড় ভাই। ঢাকাতেই থাকে। এস.এস.সি এর মতো ইন্টারমিডিয়েটে ভাল করলে সবার সিদ্ধান্তে ঢাকা পাঠিয়ে দেন মা। সেখানে গিয়ে রাকিব অনেক সমঝদার হয়ে গেছে। বাড়িতেও খুব একটা আসে না। দু একবার এসেছিল সাব্বির তখন স্কুলে ক্লাসে। এসে পায় নি। দিনে এসে দিনেই চলে যায়।
বাবু মুচকি হাসে কারণ সে আজকে বলে বেড়ানোর মতো একটা কাজ করেও বলে নি মা কে। ৫ হাজার টাকা মানিগ্রাম করে দিয়েছে রাকিবের কাছে, ওইটুকু সময়ের ভিতরে। আর একটা চিঠিও দিয়েছে সাথে। তাতে ইংরেজিতে একটা শব্দ লেখা, “সারপ্রাইজ !”।টাকা চিঠি যেটাই আগে যাক পাওয়ার পর যে রাকিব কেমন খুশি হবে তা ভেবেই সাব্বির খুশি। অবশ্য এমনি এমনি দেয় নি সে। এটা বিনিয়োগ। ভাইয়ের চাকরী হলে সে প্রতি মাসে অনেক টাকা নিয়ে উশুল করে নিবে। “হা হা হা, আমি এখন বিনিয়োগকারী ! উদ্যোক্তা !...” ভাবে সাব্বির।
দশম শ্রেণিতে এবার সাব্বির। রাকিব যখন ঢাকা যায় তখন সে ক্লাস ৬-এ। কত ছোট ছিল সে তখন। হঠাত করেই বড় হয়ে যায় দু-তিন বছরে। রাকিব চাকরী পেয়ে এসে তো তাকে চিনতেই পারবে না !
যাই হোক সাইকেলের চিন্তায় পরীক্ষাগুলো যাচ্ছেতাই হয়েছে। “তবুও শেষ হলো তো !” ভেবে হাঁফ ছাড়ে সাব্বির।
জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটলো অবশেষে।
-মা আসি...
-সাবধানে যাস। আর ট্রেনে অপরিচিত কারোর দেয়া কিছু খাবি না।
বের হতে হতে বলে
-আচ্ছা মা।
মা পিছু পিছু যাচ্ছে রাস্তা পর্যন্ত। আজকেই চলে আসবে তবুও কত বাহানা করে দেখছে ছেলেটাকে
-আর কারোর সাথে ঝামেলায় যাস না। অপরিচিত কোন স্টেশনে নামবি না কিন্তু...
-আহ মা, তুমি শুধু শুধু ভাবছ। ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দাও, ঘুমের মাঝেই ক্রিং ক্রিং শুনবে। উঠে দেখবে আমি সাইকেল নিয়ে হাজির !
ভটভটিতে চড়ে স্টেশন পৌছায় সাব্বির। সময়মতই ছাড়ে ট্রেন, মানে নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টার মধ্যেই ছাড়ে।
ঢাকা, বরাবরই একটা যন্ত্রণার নাম। জ্যাম, মানুষের ভিড়, ব্যাস্ততা। কেও কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই যেন। পত্রিকা থেকে টুকে রাখা সাইকেলের দোকানটার হদিস খুঁজে পায় সে অনেক কষ্টে। হকার, ট্রাফিক পুলিশ এমনকি ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করে। তার সরলতার জন্যেই হয়তো কেও হতাশ করে নি তাকে।
দোকানে সাব্বির।
-আসেন ভাই। (পোশাক-পরিচ্ছদ ফুলবাবুর মত না হওয়ায় কথায় খুব স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না বিক্রেতার)
ভেতরে ঢোকে সে। কত রকমের সাইকেল এখানে। টিভিতে যদিও আরো ভাল ভাল সাইকেল দেখেছে, বাস্তবে দেখেনি সে আগে। তাও একসাথে এতগুলো !
-আপনি কোন ধরণের সাইকেল চাচ্ছেন?
-জ্বি, ওই যে টিভিতে যে দেখায়। ভাঙ্গা পাথুরে রাস্তায় চালায়, স্টান্ট করা যায়...
নামটা জানতো সাব্বির কিন্তু উত্তেজনায় মনে পড়ছিল না।
-মাউন্টেন বাইক?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, জ্বি...
দোতলায় নিয়ে যায় তাকে। সেখানে শুধু মাউন্টেন বাইক, শয়ে শয়ে সাজানো।
-দাম কত কোনটার?
-আপনি আগে পছন্দ করেন। দাম নিয়ে ভাববেন না।
কথায় একটা অবজ্ঞা ছিল। দোকানি ধরেই নিয়েছিল দাম শুনে আর আগে বাড়বে না সে।
-না না, তবুও বলেন কোনটা কত?
এক একটা সাইকেলের পাশে যেয়ে দেখাচ্ছে
-এটা ১৪ হাজার টাকা... আর এই নীলটা ২০ হাজার টাকা।
এভাবে দাম বাড়তি হিসেবে সাজানো হয়ত সাইকেল গুলো।
নীল সাইকেলটা মনে ধরেছিল। নিতে পারছে না বলে মন খারাপ হল। আবার এটা ভেবেও ভাল লাগলো, “রাকিব নিশ্চয়ই এতদিনে টাকাটা পেয়ে গেছে। খুব খুশি হয়েছে নিশ্চয়ই !” ।
অগত্যা ১৪ হাজার টাকা দামের সাইকেলটাই নিল সে। সাথে একটা ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক বেল, মাকে ঘুম থেকে জাগাতে হবে যেয়ে। ১৫০ টাকা দামেরটা নিল সে।
দোকানি অবশ্য বেশ অবাক।
-স্যার আমরা তুলে দিচ্ছি রিকশায়।
সে মাথা নাড়ে। ব্যাবহারের পরিবর্তন তার চোখে পড়ে না। সাইকেল পেয়েছে সে, আর কিছু ভাবার সময় আছে?
সাইকেলটা ট্রেনের একপাশে বেঁধে নিয়ে রওনা হয় কমলাপুর থেকে।
সাব্বিরের ট্রেনটা যখন কমলাপুর থেকে ছাড়ছে সেই সময়ে টঙ্গি স্টেশন ( কমলাপুরের দুই স্টেশন পরেই এটি ) এলাকায় এক গলিতে...
-ভাই একটু দাঁড়ান। কয়টা বাজে?
-৪ টা পাঁচ ভাই।
-ঘড়িটা তো বেশ !
-বড় ভাই পাঠিয়েছে আমার জন্য।
বলতেই আরো দুইজন ঘিরে ধরে একটি ছেলেকে। বুঝতে আর বাকি নেই এরা ছিনতাইকারী।
-ভাই আমি আপনাদের ছোট ভাইয়ের মতো ভাই। ঘড়িটা আমার খুব পছন্দের, ভাইয়ের দেয়া প্রথম উপহার।
-আমাদেরও খুব ভাল লেগেছে। তাছাড়া তোমার ভাই তো আমাদেরও ভাই...
ছেলেটা কিছু বলে না আর। নীরবে খুলে দেয় হাতের সোনালী ঘড়িটা । মুখে না বললেও খোদার দরবারে বিচার দিয়েছে ঠিকই। যদিও ঘড়িটা আর পাবে না সে।
ছিনতাইকারীরা ঘড়িটা নিয়ে টঙ্গি স্টেশন আসতে আসতেই সাব্বিরের ট্রেনও ঢুকল। তিন মিনিট থামবে। সাব্বিরের ইচ্ছা করছে এখানেই নেমে সাইকেলটা চালিয়ে দেখতে !
ওদিকে নিচে থেকেও দুজন যেন দেখছিল। সে ভাবে, তাদেরও হয়ত নামিয়ে চালাতে ইচ্ছা করছে!
ট্রেন ছেড়ে দিল, গতি বাড়ছে। ওমা, লোক গুলোতো সত্যিই সাইকেল নামিয়ে নিল। মায়ের উপদেশ ভুলে যায় সে। নেমে যায় লাফিয়ে। ট্রেন চলে গেছে, সে দৌড়ে কিছুদূর যেতেই ধরে ফেলে সাইকেল ছিনতাইকারীদের, টানাহ্যাচরা-ধস্তাধস্তি শুরু হয়। এদিকে ট্রেনের ওপাশে থাকা ছিনতাইকারীদের আরেকজন দেখতে পায় এটা। কোমরে তার নতুন পিস্তল, সদ্য কেনা। নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে সব। নিজের লোকের অস্তিত্ব বুঝলো। মাথায় রঙ্গিন নেশা, “গুলির টিপটা পরখ করে দেখা যাক?”
যেই ভাবা সেই কাজ। উঠে একটু এগিয়ে গুলিতে এক টিপ দিয়ে দিল। শব্দ নেই তেমন, বিদেশি পিস্তল। কিন্তু তিনজনের একজন শান্ত হয়ে ঢলে পড়লো।
-আরে, আমার লোক মরলো নাকি?
টলতে টলতে কাছে যায় তৃতীয় ছিনতাইকারী।
-নাহ, ও দু ব্যাটা মরে নি।
প্রথম টিপেই সফল!
-অভাগাটার মুখ দেখি?
উল্টে থাকা মুখটা সোজা করতেই শরীরে হিম বয়ে যায়। আগে মৃত মানুষ দেখেনি? দেখেছে তো। বাকি দুজন বুঝতে পারে না কিছুই।
আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দেয় খুনি।
-এই সারপ্রাইজ কেন দিলি তুই! কেন টাকা পাঠালি... প্রতিদিন কেন যাস তুই স্কুলে?
বাকি দুজন তখনো কিছু বুঝে উঠেনি। সন্ধ্যা নেমে আসে।
বাড়িতে মায়ের ঘুম ভাঙ্গে ক্রিং ক্রিং শব্দে।সাইকেলে করে ডাক-হরকরা এসেছে। বড় ছেলে চিঠি লিখেছে। সে টাকা পেয়েছে। এবার বাড়িতে এলে থাকবে একদিন এমনটা লিখেছে চিঠিতে।
এদিকে বড় ভাইয়ের কোলে ছোট ভাইয়ের লাশ।বড় ভাইয়ের চেলাগুলো সাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছিল, আর একটা ট্রেনও চলে যায় ভাইদের উপর দিয়ে।
Shaon 070
#Say_No_to_Drugs
(আমিও ছোটবেলা থেকেই সাইকেল পাগল। সাইকেল নিয়ে চিন্তায় বুঁদ থাকতাম। কি ভেবে যে এটা লিখেছিলাম!
অবশ্য আজকের পুনর্লিখনটা আরেক সাইকেল নেশায় মত্য মৎস্যবিদ বড়ভাইয়ের। সাব্বির ভাই।
গল্পটা নিয়ে একটা শর্ট-ফিল্মের ইচ্ছা ছিল! কালের পরিবর্তনে বাস্তবের নায়ককে উৎসর্গ করে কিছুটা হলেও তা পূরণ হলো !)
পুনর্লিখনঃ
ভোর ৬ টা ৫০
২৮শে মার্চ, ২০১৯
মুলগল্পঃ
রাত ১২টা ১৫
৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
কোন মন্তব্য নেই
Every comment will be moderated to prevent spamming. Don't put any spam link, Please!